১
নাম ছিল তাঁর জয়িতা। নাকি জয়তী বা জয়িত্রী? ভুল
হতে পারে। শান্তিনিকেতনে পড়তেন মনে আছে। চিঠিতে বন্ধুত্ব।
প্রেম নয় বন্ধুত্ব,নিখাদ। তখন কৈশোরের
শেষ পেড়িয়ে,যৌবন নাকি তারুণ্যে পা। এইখানে ঠেক খায় স্মৃতি। যেমন ভুল হয় যৌবন নাকি
তারুণ্য। কে আসে আগে? শরীরে অথবা মনে।এখন
ভুল হয়ে যায়। কে এসেছিল আগে? চিঠি। কোন পার থেকে। এই
পাড়া দাবি করে। ঢেউ
উঠেছিল ওই পাড়া থেকে। আর ওই পাড়া বলে এপারেই পত্রাঘাতের শুরু।
মাসে অন্তত দু-তিন খানা নিয়ম করে। ঘরে ঢোকার আগে লেটার বক্সে
উঁকি-ঝুঁকি। নিয়মিত ব্যাপার। এই এল!এই এল
নাহ! কিম্বা আচমকা সন্ধ্যারাতে, প্রত্যাশিত হলদেটে ব্রাউন খাম। হাতের লেখায়
রাবীন্দ্রিকতা? ছিল না এতটুকু। গোটা অক্ষরে লেখা তাও না। অথচ একটা গতি ছিল অক্ষর
চলনে। কোন শব্দে ধাক্কা ছিল না। প্রাঞ্জল,গতিময় চিঠি। শুরু করলে
শেষ না করে থামা যেত না। কি লেখা থাকত?জানতে চাইলেমনে করতে পারবে না, কেউ।হয়ত মনে পরেও না। কুয়াশার তারাদের মত। তবে একটা ঘোর ছিল। আর যা থাকতো
তা বন্ধুত্বের থেকে অনেকটা বেশি আর প্রেমের থেকে সামান্য কিছু কম।
খোয়াই থাকত সে চিঠিতে। লেখায়। চিঠির বাঁদিক জুড়ে অনেকটা সাদা
অংশ। অসমান। কুঁচকে যাওয়া কাগজ। উঁচুনিচু। তাঁর ধার ঘেঁষে লেখা। কতটা খালি আর কতটা
লেখা। তাও নির্ভর করত তাঁর মুডের ওপর। কুঁচকানো কাগজের না লেখা অংশে থাকত ওই
খোয়াই। জানতে চাইলে লিখত, ‘ওই ফাঁকা অংশ,ওই অসমতল
উপত্যকাই খোয়াই।’ ওইখানে উঁচু নীচু চাপ পড়ত। শরীরের। ভূগোলের ম্যাপের মত। কারণ চিঠি নাকি শুয়ে শুয়ে লিখতে
হয়। হয় বিছানায়। নয় মাঠে। মাঝে মাঝে প্রমাণ স্বরূপ, বালিশের ওয়ারের সুতো, কিছু
দুব্বো ঘাস, লাল মাটি-ধুলো চলে আসত খামে। একদিন কৌতুহলে জানতে চেয়েছিল ছেলেটি। এই
পারের কোন তৃণভোজীর জন্যলেখা কিনা। তারপরই দীর্ঘ ব্যাখ্যা।
‘‘তৃণভোজী সে পছন্দ করে না। তৃণভোজীর সঙ্গে তার খাদ্য খাদক সম্পর্ক। অর্থাৎ তৃণভোজীরা
বেশির ভাগই তাঁর খাদ্য।’’ জানিয়েছিল মেয়ে। বলেছিল চিঠিতে। লিখেছিল তিনি আমিষ। একদা
তার পূর্বপুরুষরা নিরামিষাশী হলেও। পশ্চিমে,আরো পশ্চিমে তাঁদের আদি বসত। আজো আছেন কেউ কেউ। বহুদিন আগে এসেছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষরা। এই বাংলায়। না, রবীন্দ্রনাথের টানে
নয়। বরং ভাগ্যের সন্ধানে। একসময় কাজের সুবাদে, জড়িয়ে গেছিলেন শান্তিনিকেতনের
সঙ্গে। সেই থেকেই তাঁর প্রেম। রবি-রোদ্দুর আর রাগ। ভালবাসা বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে। রাঢ়ের রুখু মাটির সঙ্গে। যেখানে আমিষ গন্ধ মেশা টকসা-শান্তি। পছন্দ এই নিকেতনের রহস্যময়তা। হাঁটুজল নদী, পাশেই ঊষর জমি, সঙ্গী উচু-নীচু
টাঁড়, রৌদ্র-রুক্ষতা, আর বর্ষার আসঙ্গ। সবুজ
ঘাস,
গহন পাতায় বৃষ্টি। তাঁর ভালো লাগে। কিন্তু বেশি ভালো লাগে ঊষর লাল মাটি রুক্ষতা। হলদে হয়ে যাওয়া অপেক্ষার
প্রান্তর। আচমকা ঝড়।
অঝোর বৃষ্টি। লাল তৃষ্ণার্ত জমিতে। ভেজা মাটি ছুঁয়ে সোঁদা গন্ধ। আর পাকিয়ে ওঠা
ধোঁয়া। আমিষ আর শিকারীর মত।
‘সেই দিন বৃষ্টি নেমেছিল।’
রীতিমত। সেও এক অন্যদিন। খোয়াই-এ। তারও বর্ণনা ছিল চিঠিতে। কিভাবে ‘দৌড়ে নেমেছিল
ঝড়। খোয়াই-বুকে।’ মাঠে
শুয়ে বন্ধ চিঠি বিলাস। শুরু হয়েছিল
দৌড়। মেয়ের। হাওয়ায় ওড়া আঁচল। খোলাচুলে মেঘ ঢেকেছিল। ‘ধুলো মাখা আধ-ভেজা চিঠি
লুকানো হয়েছিল। বুকের গভীরে।
বিভাজিকায়। তবু কালো কালিতে বৃষ্টির ফোঁটা। ধেবড়ে দিয়েছিল কিছু অক্ষর। আধখানা
লাইন।’ তবু পড়া যাচ্ছিল। আবছায়ার গোপন উচ্চারণের মত।
তবু অনুশোচনাও ছিল। ‘ইস...শেষ পর্যন্ত বৃষ্টিও ছুঁয়ে দিল চিঠি?’
আরো একদিন...। ‘‘বৃষ্টি
রোদ্দুর দুই-ই ছিল আকাশে।’’ কি ভাবে থাকে? সে তো সব্বাই জানে। নাহ! কোন সু-রিয়ালিজমের কারসাজি নয়। ‘‘কালো স্তূপ
স্তূপ মেঘের আড়াল থেকে ছিটকে পড়েছিল আলো। ছেঁড়া আলো। একটু বাড়তি রঙিন। অনেকটা
বাড়তি কমলা। কমলা রঙের রোদের মাঝে বৃষ্টি। যেন আরো কমলা রোদ বিছিয়ে দিয়েছে
প্রকৃতিতে। গাঢ় কালো
মেঘের মাঝখান থেকে ছিটকে আসা গেরুয়া আলো পড়েছিল সবুজে
আর নীলে। আর একপাশে অঝোর বৃষ্টি। বৃষ্টি ভিজে প্রকট হচ্ছিল সবুজ।’’ অ্যাসফল্টের বুকেও গুমড়ে ওঠা বাষ্প। ভেজা পরিধান। আর নীলচে-কালো আকাশ। সেই রাতে গেরুয়া
রঙের একটা খাম পড়েছিল মহানগরের লেটারবক্সে। ইন্টারভিউ-এর চিঠি যেমন হয়। তখনতার উথাল-পাথাল
সময়। আকাশের রামধনু মনে।
তখন বেকার দিন। টিউশনি সময়। একটা কাজ ছিল। যা প্রায় না থাকার
মতই। মাসে পাঁচ দিন শুটিং। ছয় দিন এডিটিং। ভোর
রাতে বেরিয়ে মাঝরাতে ফেরা। ক্যামেরায় চোখ রেখে ফুটিয়ে তোলা ঘটনাবলী।
লাইট-সাউন্ড-ক্যামেরা-অ্যাকশন পেরিয়েও অন্য এক জীবন। রোমাঞ্চের। কাজের। তবে ‘অর্থ’হীন।
কারণ টাকাপয়সা মিলত সামান্যই। পরিশ্রমের
তুলনায়। পাঁচদিন টানা শুটিং সেরে দুদিনের বিশ্রাম। ফের টানা ছয়-রাতের এডিটিং।
জানিয়েছিল সদ্য যুবক নাকি তরুণ। দুই কাজের মাঝে তখন অনন্ত
ছুটি।হাতে অফুরন্ত সময়। আর সামান্য অর্থ। একটা চাকরির ডাক আসা মানে, হাতে স্বর্গ। দুরু দুরু বুকে খাম হাতে নিয়েই ছেলেটি দেখেছিল অপরিচিত ছাঁদ।
চাকরির ডাক নাই বা এল। অন্য ডাক তো আসে। সেই প্রথম। বেহদ্দ বেকার জীবনে তাই বা কম
কি? ছলাত-ছল শব্দটার সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়। আচমকা বেড়ে
গিয়েছিল ঢিপঢিপ আওয়াজ। এক মুখ উষ্ণ স্রোত। টের পেল রামধনু। জলের ফোঁটায়। লেটারবক্সের গায়ে।
ফোঁটা ফোঁটা জলের অবশেষ। সে
লেখায়। কান্না নয়, পেয়ে হারানোর আকুলতা। শব্দের গতিতে ঝড় ছিল।
জানিয়েছিল হারিয়ে গেছে। খুঁজে দিতে হবে তাকে। তার ডাক এসেছে। এই ডাকাডাকির মাঝখানে
আকুলতা আছে। ব্যস্ত ঘরোয়া ছোটাছুটি আছে। সেই জন্যই এতো আয়োজন। দিস্তা খাতার বাঁ দিক জুড়ে খোয়াই। তার
মাঝে তির তির করে বয়ে চলেছে লেখা। এঁকে বেঁকে। মাঝপথে রঙ বদলেছে কালি। কালো কালি কলম ছেড়ে কালো ডটে। পেন বদলের আগে,শেষের দিকের লেখাগুলোয় ফোঁটা-ফোঁটা জল।
শুকিয়ে কাঠ। ঝাপসা চোখে লিখলে যেমন হয়! কাঁদছিল কি মেয়ে। কেঁদেছিল? লেখার সময়?
একগুছি দুব্বো, রাঙা-ধুলো আরদীর্ঘ একটি কালো চুল...। কোঁকড়া। মিশ
কালো। বর্ণনায় ছিল তার কথাঃ "কেন এমন হয়? কথা দিলে কথা
রাখতে হয়...এই কথা বলে কেন সে চলে গেল,কথা-না-রেখে?...”
এ এক অমোঘ প্রশ্ন!! কে দিয়েছিল কথা? কোন কথা? কেন গেল? উত্তর মেলেনি। পরের লেখায়। তবে বোঝা
গেছিল তীব্রতার দহন। কথোপকথন শেষে তাঁর ওই দীর্ঘ কালো কেশের কথা বলেছিল, কেমন করে
কপাল আর গাল ঝাঁপিয়ে, নেমেছিল লেখার দিস্তা কাগজের ওপর। বর্ষার মেঘের মত। “আখোলা
পিঠ ছাপিয়ে তখন বিকেলের রোদ। নরম। আরো
নরম হয়েছিল। ওই পিঠের উপত্যকায়।”
ডান হাতে বারবার ওই অলকগুচ্ছ সরাতে গিয়ে কি বাধা পড়ছিল লেখায়? বিষয়ান্তরে যাওয়ার আগের বিরতিতে, কি
ফের কেঁদেছিল মেয়ে। ডুবে গিয়েছিল ভাবনায়। কালি-পেন ছেড়ে, চুল সরানোর ছলে,কানের পিঠে হাত রেখে কি অপেক্ষা
করেছিল কোন স্মৃতি।...এক ঝুপুস কালো বিন্দুর পর ফের শুরু হয়েছিল লেখা, “জানো একদিন...”
২
একদিন মেঘ ডেকেছিল। বইয়ের তাকে ওলট-পালট নোটস-খাতা-কিতাব। শুধু একপাশে দাঁড়িয়ে। কালো-কালির দোয়াত আর পাথরের পেনদানি। দড়িতে জামা-কাপড়। মেয়েদের। এলোমেলো উড়ছিল। যেমন থাকে হস্টেলের ঘরে। অগোছালো। বৃষ্টি নামবার কথা ছিল না।
অমন ভরা গ্রীষ্ম দিনে। তবু ঝড় এসেছিল। কালবৈশাখী। শান্তিনিকেতনে নাকি এমন হামেশাই
ঘটে থাকে। “এলোমেলো
মেঘে,
লাল ধুলো-ঝড়। ঢেকে যায়। সবকিছু। হাওয়া বয়। পাগলামির পাকে আবর্তে।
হাহাকারের মত। খোলা জানালায়। কপাটের দুরন্তপনায়। বাতাস ঝাপট। মুহূর্তে লাল-ধুলোয়
ভরে যায় ঘর। কিন্তু বৃষ্টি নামে না।”
এমনই ভ্যাপসা এক গ্রীষ্ম-দুপুরে, মেঘ ডেকেছিল
তাঁকে। “মেঘ এসেছিল
ঘরে। ঝড় উঠেছিল। উদ্দাম। আর আশ্চর্যরকমের অন্যবৃষ্টি ভিজিয়েছিল তাঁকে। সেই তাঁর
প্রথম অনুভূতি। অনন্য বৃষ্টি-স্নানের। বই-এর তাকের মত এলোমেলো। খাট-বিছানা-বালিশ। সবকিছু। বাইরে বারান্দায় তখন ক্লিপে বাঁধা
পোষাক ডানা পেয়েছে। উড়ন্ত শয্যা।”
জানালা দিয়ে দেখেছিল সে। আধখোলা চোখে। সেও উড়ছিল ডানা-হীন ক্লান্ত ডানায়। “হালকা হয়ে গেছিল। শরীর-মন সবকিছু। ক্লান্তির আশ্লেষে ঘুম
ঘুম চোখে দেখেছিল মেঘ সরে যাচ্ছে। আর এক আলো।
অনির্বচনীয়। তেরছা হয়ে। খাট বেয়ে বিছানায়।”
তাকে যেন ছুঁয়ে আছে দিনশেষ-মুহূর্ত। কে যেন গেয়ে উঠেছিল। পরুষ কন্ঠেঃ ‘দিবস রজনী
আমি যেন কার...’
সেই সন্ধ্যায় লিখেছিল ফের। দ্বিতীয়বার। আরেক খোয়াই অববাহিকায়।
কেমন করে “ঝড়ে ভেঙ্গে চুরে গেছে কোপাই। তালসারি পাড় বেয়ে ক্ষত বিক্ষত জমি। কেউ যেন
দাপিয়ে বেরিয়েছে। অবিরত। ঝরে
পড়া পাতা ডালে লাল খোয়াই-এ শরীরে যেন সবুজ নক্সা।”
তাঁর ভাল লেগেছিল। “ভাঙ্গন নয়। নক্সা। প্রকৃতির পাড়ে তখন সন্ধ্যা নেমেছিল। নামছিল।
ধীর পায়ে। দু-চারটে তারা ফোঁটা সময় তখন। ভেসে
আসছিল। বুনো ফুল আর ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ।” কাদা মাটি আর গুল্ম জড়িয়ে ধরছিল তাঁর
শাড়ির পাড়। সেখানেও মেটে সবুজ রং। “পায়ে
তখন নাচের ছন্দ। বৈতালিকের শেষে ঘরে ফেরা ডাহুকের মত। গরবিনী। শরীরে যন্ত্রণা। অথচ
মধুর প্রথম অনুভূতি।”
ওইখানেই শেষ। সে চিঠির। জবাব লেখার দায়ের থেকেও বেশি যেটা ছিল
তা হল,
“তারপর... ...।” গল্পে যেমন ‘তারপর’ থাকে। তেমনই। চিঠিতে কী তারপর
কিছু থাকে? তবু গিয়েছিল চিঠি। এই প্রশ্ন নিয়ে, “তারপর... ...।" যেমন
যায়। যেত। এপাড় থেকে ওপাড়ে। জবাব
মেলেনি। এপাড়ে কি কাব্য থাকত? মনে পড়ে নাহ। বরং, অপেক্ষা
থাকত। তবে, ওপাড়ের আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল। জবাব লিখিয়ে নেওয়ার।
এক-এক চমকিত অধ্যায় থাকত।
শিহরণ জাগাত তরুণ হৃদয়ে, যুবতীর কাঁপন তোলানো ঢেউ।
আরেক চমক থাকত। শুরুতেই প্রেরকের নাম। চিঠিতে। জয়িতা, বা জয়তী নাকি জয়িত্রী !!! আর, চিঠি শেষে দিস্তা পাতার একদম বাঁ দিকের নীচে লেখা থাকত। প্রাপকের নাম। ‘নৈঋত। তোমাকে।’ সম্বোধন বিহীন। এমনই স্পর্ধা! যেন "আমি লিখছি চিঠি,এই কি যথেষ্ট নয়"। তাই শুরুতেই প্রেরকের নামে নামাঙ্কিত হত চিঠি। আর শেষে একদম তলাকার জমিনে পড়ে থাকতেন প্রাপক। অবহেলায় নয়, যেন ওইখানেই তাঁর জমি। চিঠির নৈঋত কোণে।
আরেক চমক থাকত। শুরুতেই প্রেরকের নাম। চিঠিতে। জয়িতা, বা জয়তী নাকি জয়িত্রী !!! আর, চিঠি শেষে দিস্তা পাতার একদম বাঁ দিকের নীচে লেখা থাকত। প্রাপকের নাম। ‘নৈঋত। তোমাকে।’ সম্বোধন বিহীন। এমনই স্পর্ধা! যেন "আমি লিখছি চিঠি,এই কি যথেষ্ট নয়"। তাই শুরুতেই প্রেরকের নামে নামাঙ্কিত হত চিঠি। আর শেষে একদম তলাকার জমিনে পড়ে থাকতেন প্রাপক। অবহেলায় নয়, যেন ওইখানেই তাঁর জমি। চিঠির নৈঋত কোণে।
কলকাতার ছেলেটির নাম নৈঋত শুনেই নাকি চমকিত হয়েছিল মেয়ে।
লিখেছিল প্রথম চিঠিতেই। কোন এক উপন্যাসের উদাহরণ দিয়ে। নৈঋত কোণেই নাকি জমে
সব্বোনাশের মেঘ। পত্রবন্ধুর প্রথমেই সর্বনাশ। ভেবেছিল তরুণ-হৃদয়। শঙ্কা ছিল। ভীত জবাবে জানতে চেয়েছিল।
আশঙ্কায় ইতি? নাকি চিঠি বন্ধুত্বের শুরুয়াদ। জানিয়েছিল মেয়ে।
সিঁদুরে মেঘ সে চেনে। চেনে ঈশান,অগ্নি, আর বায়ুকে। পরিচিত
হতে চায় নৈঋতের সঙ্গে। সর্বনাশের সঙ্গে।
সর্বনাশের গল্পটা অসমাপ্তই থেকে গেছিল। যেমন থাকে। থাকত। জানতে
চেয়েও জানা হয় নি কোনদিন। তবু জানার অথবা জানাবার অপেক্ষা যেমন থাকে। তেমনই থাকত,
তারপর, কি...? কালবৈশাখীর পর কি? জবাব মেলেনি। তেমনই জবাব আসেনি, সর্বনাশের পর
কি? তবু এরপর, বৃষ্টির পর শরত এসেছে। এসেছে ফুল তোলার কথা। শিশির জমানো কচি শালের পাতা। কিম্বা
সূর্য ওঠার মুহূর্ত। কুসুম কুসুম আলো। সোনাঝুরি গাছে রোদ্দুর। শিউলি কুড়ানো ভোর। শিউলি বোঁটা থেকে
রঙ নিয়ে রাঙানো আঙুল। সেও শুনেছিল ছেলে। প্রথমবার। লিখেছিল সে। তার আঙ্গুলের কাহিনী।
কি করে আঙ্গুলে কাঁটা ফোটায় ক'দিন লিখতে পারে নি। চিঠি আসতে দেরী হয়েছিল।
তখনি নাকি প্রথমবার সেও দেখেছে তার আঙুলগুলোকে। পরম যত্নে আর ভালবাসায়। সেবারই
নাকি শিউলি-বোঁটা-রঙ পেরিয়ে প্রথম নেলপালিশ।
লিখেছিল, কিভাবে তর্জনী থেকে বার করা হয়েছিল কাঁটা।
ফরসেপ দিয়ে টেনে নখের নীচের থেকে। গেঁথে যাওয়া বেলকাঁটা। তারপর সেলাই। একটা-দুটো।
সেই তার দ্বিতীয় রক্তপাত। রক্ত-দর্শন। তারপর ওষুধ ব্যান্ডেজ তুলো যন্ত্রণা।
ডাক্তারবাবু বলেছিলেন নাকি, চিন্তা নেই। আঙুলে দাগও থাকবে না। মিলিয়ে যাবে। আর ভুলেও যাবে একদিন। এই
ক’দিনের সহ্য সময়টুকুও কেটে যাবে। সহ্য
করেছিল মেয়ে। আর সযত্নে দেখেছিল, প্রতিদিন। কিভাবে “একটু একটু করে ক্ষত শুকায়। যন্ত্রণা কমে।
গোলাপি-আভা ফেরে হাতে,আঙুলে। খুলে যায় প্রশমনের আড়াল। সাদা-কাপড়ের
আড়ালে পুরানো রক্ত-পুঁজ সহ খসে পড়ে যন্ত্রণা। অতীতের মত। থেকে যায় দাগ। তারপর,সময়ের সঙ্গে
সঙ্গে সে দাগও মিলিয়ে যায়। মিলিয়েও গেল। শুধু রয়ে গেল স্মৃতি। আর অভ্যাস। প্রথম নেলপালিশের।” ক্ষতচিহ্ন ঢাকার তাড়নায় একদিন প্রথমবার যা পড়েছিল সে।
অভ্যাসের চিঠিতে লিখেছিল, ‘...একদিন এইসব যন্ত্রণা ছুঁয়েছিল
তাকে। তখন,
নাকি তারও আগে, প্রতিদিন, নিজেকে একটু একটু করে চিনে নিয়ে ছিল সে। নিজেকে, নিজের আঙুলকে। হাত দুটোকে।’ লিখেছিল “পলি-রঙা আঙুল” তার। তার শরীরের মতোই। হাল্কা গোলাপি
রঙা নখ। হাড় বিহীন পাঞ্জা। "গোলপানা। টেপাটোপা।" এ তার নিজস্ব শব্দবন্ধ।
সেইদিন জেনেছিল নৈঋত। পলি একটা রঙের নামও হয়। লিখেছিল, “পলি রঙের তর্জনীতে সাদা ব্যান্ডেজ কেমন আসুরিক! তবে অরসিকও মনে হয় না।
একটাই অসুবিধা শুধু চামচে করে খেতে হয়। স্পর্শবিহীন খাদ্যে নাকি স্বাদ মেলে না আর
লেখা যায় না”। হস্টেলের ঘর-বন্ধুরাই
সাফ-সুরত করে। তাঁর কুঠুরি। গোছগাছও তারাই। ঘরটা নাকি অনেক বেশি পরিস্কার লাগে। বড়
মনে হয়। খোলামেলাও।
এরপর খালি...অনেকটা অঞ্চল জুড়ে সাদা পাতা। খোয়াই ছাপিয়ে।
উঁচুনিচু পেড়িয়ে। ওইখানে তার হাতছাপ। ব্যান্ডেজ-সহ।
প্রমাণ-স্বরূপ। তারপর লেখা,-“আবছায়া খোয়াই থেকে অবয়বে আসার অজুহাত হতে
পারতো হাতছাপ”। তাই অজুহাত
নয়। বরং জানিয়ে দেওয়া, “তার চুলে বিনুনি হয় নি বেশ কয়েকদিন। এলোমেলো
কোঁকড়া চুল এখন খোঁপা ভেঙে পিঠ ছাপিয়েছে। আধশোয়া লেখার জন্য দিস্তে পাতার পরতে
পরতে গন্ধ-তেলে মাখামাখি। তাঁর আঙুলে রক্তের গন্ধ আর বুকে চাঁপার !”
শান্তিনিকেতনের মেয়েদের এই এক গোপন বিলাস। বর্ষার দিনে,শরীরে স্বর্ণচাঁপার গন্ধ মেখে নেওয়া। আশ্চর্য হয়ে জানতে চেয়েছিল তরুণ নাকি
যুবক মন। কেমন সে দস্তুর। পরের চিঠিতেই বিবরণ। জবাবে যা লিখেছিলেন তার ব্যাখ্যা
লেখিকাই জানেন। প্রাপক শুধু জানেন,“শালের সবুজ টুকরিতে স্বর্ণচাঁপা কেনার ধুম লাগত
বর্ষা দিনে। কুঁড়ি ফুটে ওঠার আগেই দখল করতে হত টুকরি। তারপর সেই স্বর্ণচাঁপার
স্থান হত বিভাজিকার গভীরে। উষ্ণতায়
ওমে একসময় নাকি, ফুটত কুঁড়ি। ম-ম’ করত
চারপাশ। ফুলের হদিশ পেতেন না কেউই, শুধু গন্ধে মাতাল থাকত
ক্লাসরুম। পাশের ছাত্রের কৌতূহলকে বুড়ো-আঙুল দেখিয়ে ক্লাস-রুমথেকে একেকটি স্বর্ণচাঁপারা বেরিয়ে আসতেন। মাতোয়ারা
মেজাজে। আর ছেলের দলবোকা,কৌতুহলী,বুদ্ধিমানেরা,জানা-অজানার মাঝখানে। এক নিষিদ্ধ-পরিশুদ্ধ অথচ নিখাদ জিজ্ঞাসায় হতবাক!”
৩
জিজ্ঞাসা এ-পারেও ছিল। ওই ছাপে হাত রেখে মাপ নিয়েছিল। নাকি
স্পর্শ! অন্তত এক কড় ছোট সেই হাত। পদ্মকলির মতন নরম এবং মসৃণ? নাকি চিঠি কাগজের মত। আইভরি হোয়াইট। আর খসখসে। ঐ কাগজই স্পর্শ পেয়েছে
তাঁর। না পাঠিয়েছে তাঁকে। এই
ভাবেও ছুঁয়ে থাকা যায়। আঙুলে আঙুল। শরীরে শরীর। ১৬৫ কিলোমিটার দূর থেকে। জেনেছিল
প্রাপক। ছুঁয়েছিল সে হাত,আঙুল। অন্য এক সন্ধ্যায়। এক চাঁদ-বিহীন রাতে।
রোমাঞ্চহীন অমাবস্যায়। অমাবস্যায় গোপনীয়তা থাকে। অন্ধকার নয়। অন্ধকারে জেগে ওঠে
জোনাকি। ভেসে যায়, নিভে যায়, ফের
জ্বলে-নেভে। এপারেও নিষিদ্ধ স্পর্শ মনে হয়। জ্বলে
আর নেভে। সিগারেটের আলোর মত। স্পর্শে
কি আগুন থাকে? নাকি অবশেষ উষ্ণতা শুধু। ছাই
হয়।
উষ্ণতাকে ক্যামেরায় ছুঁয়ে রাখা যায়। ছোঁয়া যায় আলোময় অবাস্তবতাকে।
তৈরি করা যায় ইলিউশন। মিথ্যেকে সত্যি তৈরি করা যায়। এক লহমায়। মাঝখানের দাগ যায় গুলিয়ে।
ভেসে যায় অনুভুতি। ভাবনা। আলো এবং অন্ধকারের। এমনই এক অন্ধকার রাত। একলা ছাদে
ধূমপান। নিজের সঙ্গে কথা। অন্ধকারের অবকাশে। অচেনা সেই মেয়ে। যাকে মুখোমুখি দেখলে
চিনতেই পারবে না। সেও কি পারবে? কোন একদিন, যদি মুখোমুখি
হেঁটে এসে বলে চেন কি আমায়? চিনবে? চেনা
যায়! "যদি এক-চিঠি দূরত্বে এতখানি আবেগ থাকে। তাহলে নাকি চিনে নেওয়া
যায়।" লিখেছিল নৈঋত। লিখেছিল
নাকি? এমন কাব্য!
লিখেছিল নাকি। মনে পড়ে নাহ ! তবে কলকাতা পথে পলিরঙা মেয়ে
সন্ধানে কতবার কত পথ ভুল। কত বেভুল পথচলা পথে-গলিতে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে চোখ। কাকে
ঠিক পলি-রঙ বলে। গঙ্গার বুকে
জমে পলি। তাই দেখে রঙ
চেনা যায়?
নোনা ধরা দেওয়াল ঘেঁষে জমে থাকা পলি। হাইড্রেনের পাশে গঙ্গা-কলে
জলের উচ্ছ্বাস। পলি চেনা রঙ বুঝি? শ্মশানের পোড়া কাঠ।
পচা ফুল,
ঝরাপাতায় ধুসর। মহানগরে পোড়া ডিজেলে পলি রঙা ধোঁয়া। নাকি কালো?আকাশবাণীর আবাহনির সঙ্গে মিশে
থাকা প্রথম আঁচ। উনুনে। ছাই-ঢিপি। পলি-ধোয়া বুঝি?
কতবার সিগারেট ধোঁয়ায় সন্ধ্যা নামার মুহূর্তে মনে পড়েছে। জোড়াসাঁকো কেন শান্তিনিকেতন হয় না। সেবারই ঠিক করেছিল। যেতে হবে। চমকিত করে দিতে হবে সেই নারীকে। গঙ্গা পাড়ের মেয়েদের মত "পলি যার গায়ের রঙ"। আঙ্গুল "গোলগাল-টেপাটোপা"। “কোমর ছাপানো চুল। কোঁকড়া। তর্জনীতে জমাট ব্যান্ডেজ।” থাকে নাকি এতদিন? তবুও তো দাগ থেকে যায়। ক্ষতের। আর কলমে আঁকা হাতের অবয়বের ছবি। নাকি স্পর্শ। এটুকুই চেনাশোনা। আর চেনা,অচেনা খোয়াই।
কতবার সিগারেট ধোঁয়ায় সন্ধ্যা নামার মুহূর্তে মনে পড়েছে। জোড়াসাঁকো কেন শান্তিনিকেতন হয় না। সেবারই ঠিক করেছিল। যেতে হবে। চমকিত করে দিতে হবে সেই নারীকে। গঙ্গা পাড়ের মেয়েদের মত "পলি যার গায়ের রঙ"। আঙ্গুল "গোলগাল-টেপাটোপা"। “কোমর ছাপানো চুল। কোঁকড়া। তর্জনীতে জমাট ব্যান্ডেজ।” থাকে নাকি এতদিন? তবুও তো দাগ থেকে যায়। ক্ষতের। আর কলমে আঁকা হাতের অবয়বের ছবি। নাকি স্পর্শ। এটুকুই চেনাশোনা। আর চেনা,অচেনা খোয়াই।
মন পড়া যায়? এতদূর থেকে। মনে পড়া।
এক কথা। তাই বলে মন পড়ে ফেলবে। নইলে কেন লিখবে পত্রবন্ধুত্বে দেখা হতে নেই। তবু
তার তীব্র ইচ্ছে। একদিন যদি। যদি দেখা হয় হঠাত।...তারপর, তারপর এক দীর্ঘ অধ্যায় জুড়ে লেখা "কেমন করে চিনিব তোমায়?"
চেনা যায় অনায়াসে। এমন বর্ণনা সহজ নয়। "সহজ নয় বলেই ছবি নয়।
শুধু বর্ণনা।" আয়নার মুখোমুখি বসে। এরপর একে একে নিজেকে চেনানো। কেশ মুখ বুক
ছুঁয়ে পায়ের পাতা। শেষে ব্যবহার করেছিল এক আশ্চর্য শব্দবন্ধঃ "যে নারীকে মনে
হয় এক মাঠ নদী।"
"এক মাঠ নদী। এক মাঠ নদী এখন। অঝোর বর্ষায় যেমন
বিলকুল নদী হয়ে যায় মাঠ। ঠিক তেমন।" বলেছিল মেয়ে। লিখেছিল। "জলভাসি মাঠে
যেমন মাথা তুলে জেগে থাকে অসংখ্য সবুজ ঘাস। দুহাত
তুলে ডাকে আয়-আয়। তেমনই ডেকেছিল ছেলেকে।”
প্রথম আবাহন। আবাহনের নদী মাঠময়। মাঠ ডাকে আকাশকে। নাকি
উল্টানো আকাশকে। মেঘ-ছবি বুকে নিয়ে যেমন ঘাসজমি ডাকে। ঠিক তেমন। ডেকেছিল চিঠি
বন্ধুকে। চলে এস। চিনে নাও। আয়নায় দেখা বর্ণনা শুনে। নাকি পড়ে।
সবুজ ঘাসে এসে ঠেক খায়। শহুরে যুবক। বাস্তবতার শহুরে মন। ভাবে। ভাবনায় নারী নদী হতে
পারে। উচ্ছ্বল। বহমান। তরঙ্গায়িত।
সবুজ ঘাসে ধরা পরে কোন অনুষঙ্গ? সেকি সুখ নাকি বিষাদ। বিষাদের আবাহন থাকে
নাকি। নাকি আবাহনের অধিকার শুধু সুখেরই। মেঘ-ছবি দেখা যায়। জলভরা মাঠে। প্রতিফলনের
জলে নেমে আসে আকাশ। আয়নায়
যেমন। ধরা পড়ে মেয়ে। পলি রঙা। নদীর মত তরঙ্গায়িত শরীর। বুকের নীচে বালিশ নয়, দিস্তা পাতার একাংশ। হলদে আঁচল কাঁধ ধরে ঝুলে থাকে। নিরালম্ব। যে কোন সময় নেমে আসতে পারে। অকস্মাৎ।
নেমে আসে যদিও। খসে পড়ে না। হাল্কা হাত-খোঁপায় একলা হাস্নুহানা। একমুঠো রঙের মত।
চমকিত আবির। পাশের জানালা বেয়ে এক পশলা রোদ। কোমর ছাপিয়ে নেমেছে পায়ে। বিকেল
বেলার। সরে যাওয়া মেরুন শাড়ির আড়াল থেকে আদুল পায়ের গোছ। ফর্সা রোদ্দুর নেমেছে
বিছানা ছুঁয়ে খাটের বাজুতে। আয়না দিয়ে দেখা যায় সেই আলো। ছায়া-ছায়া। আল্পনার মত, মেঝেতে। আর ছায়া মাখা মুখে। কোঁকড়া চুলের। গালের পাশে আল্পনা। নাহ কোন টোল নেই, তিল নেই। তেল নেই।
মুখে কিম্বা চুলে।
"এই তো মেঘ ঢাকা চোখ। পালকের মত ভ্রু
পল্লব। বর্ষার মত ঝাঁপিয়ে পড়া কোঁকড়া চুল। স্পর্ধিত গ্রীবা মরালের মত।"
লিখেছিল সে। চিঠির জবাবে। দেখেছিল যুবক। এই সব কিছু। কেমন করে কল্পনায় চক্ষুষ্মান
হয়েছিল সে। কেমন করে সে পৌঁছে গিয়েছিল। শ্যামলী পেড়িয়ে ওই লালপথ হোস্টেলের
রাস্তায়। যার জানলায় কোন পরদা থাকত নাহ। পুরানো কাঠের ঝাঁঝরি। লোহা শিক আর রঙিন
কাঁচের শার্সি দিয়ে রোদ্দুর আসত। রঙবেরঙের। আসত বৃষ্টি-মেঘ, বাতাসও।
বারান্দায় মেলা শাড়ি আটকে যেত উঠে থাকা পেরেকে। যা নিয়ে অভিযোগের অন্ত ছিল না
মেয়ের। ডানা মেলে শাড়ি উড়ত বেপরোয়া। কিন্তু তারের বাঁধন ছিঁড়তে পারতো না। যেমন
পারেন নি সেই মেয়ে। শান্তিনিকেতনের।
যেমন পারেনি দলে যেতে ফুল। লিখেছিল একদিন। কোন এক বৈকালিক চিঠিতে। “পথ চলা দায় হয়ে উঠছে ক্রমশ। শান্তিনিকেতনে। রীতিমত এক্কা-দোক্কার মত লাফিয়ে পার হতে হচ্ছে পথ।” তারপরেই ব্যাখ্যা। “খানা-খন্দ নয়। এই বসন্তে ফুলের সমারোহ। গাছ থেকে টুপটাপ ঝরে পরেছে ফুল। এলোমেলো। ইচ্ছে মত। যেন ফুলবীথি বা ফুলের পথ।” সেটাই নাকি বিপদের কারণ। “লাল-হলুদ-আবির রঙা ফুলে ঢেকে থাকা পথ তাঁকে ডাকে, আয়-আয়। কিন্তু ফুল মাড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা। তাই কোনক্রমে পা-টিপে টিপে যাতায়াত। এক-আঙুলে ভর দিয়ে ফুল বাঁচিয়ে যাওয়া-আসা।” এরপরেই স্বগতোক্তির ঢঙে লেখা। “ফুলেদেরও মন আছে বুঝি। তাহাদের মত। নারীদের মত। যাকে লালন করতে হয়। যত্নে আর ভালবাসায়।”
যেমন পারেনি দলে যেতে ফুল। লিখেছিল একদিন। কোন এক বৈকালিক চিঠিতে। “পথ চলা দায় হয়ে উঠছে ক্রমশ। শান্তিনিকেতনে। রীতিমত এক্কা-দোক্কার মত লাফিয়ে পার হতে হচ্ছে পথ।” তারপরেই ব্যাখ্যা। “খানা-খন্দ নয়। এই বসন্তে ফুলের সমারোহ। গাছ থেকে টুপটাপ ঝরে পরেছে ফুল। এলোমেলো। ইচ্ছে মত। যেন ফুলবীথি বা ফুলের পথ।” সেটাই নাকি বিপদের কারণ। “লাল-হলুদ-আবির রঙা ফুলে ঢেকে থাকা পথ তাঁকে ডাকে, আয়-আয়। কিন্তু ফুল মাড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা। তাই কোনক্রমে পা-টিপে টিপে যাতায়াত। এক-আঙুলে ভর দিয়ে ফুল বাঁচিয়ে যাওয়া-আসা।” এরপরেই স্বগতোক্তির ঢঙে লেখা। “ফুলেদেরও মন আছে বুঝি। তাহাদের মত। নারীদের মত। যাকে লালন করতে হয়। যত্নে আর ভালবাসায়।”
দুঃসাহসী পাঠক নৈঋত। ছুটিয়েছিল তার কল্পনার ঘোড়া। কালো বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া
বিকেলের কথা লিখতে চেয়েছিল। সেই ফুল ছোঁয়া শেষ দুপুরের আলো। কেমন করে উথাল পাথাল
হবে বিকেলবেলা। সন্ধ্যে নামা
মুহূর্তে পলি রঙা মেয়ে। পাশাপাশি হাঁটবে। কেমন করে
তার ঊড়তে থাকা আঁচল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবে তাঁর পুরুষ হাতের পিঠ। যেন ডাকবে স্পর্শে। আঙুলে আঙুল
ছোঁয়া মুহূর্তে কেমন করে চমকিত হবে বিদ্যুৎ। শরীরে শরীর। স্পর্শের আগেই চিনে নেবে
চোখ। বুঝে নেবে ইঙ্গিত। ওই বিলীন ক্ষতচিহ্নে আঙুল ছোঁয়াবে সে। যেন ওই স্পর্শ উধাও
করে দেবে যন্ত্রণা চিহ্ন। তবু চিহ্ন থেকে যায়। ক্ষতের। চিহ্ন থেকে যায়। মনে,শরীরে আর
প্রকৃতিতে।
৪
প্রকৃতিতে বাঁধন থাকে। বাঁধনের চিহ্নও থাকে। জীবনে যেমন। তেমনই চিঠিতে। কোন বন্ধন ছিল নাকি? সম্পর্কের। এনিয়ে
নিজের সঙ্গেই বহুবার ঝগড়া করেছে নৈঋত। নিজের চিঠির সঙ্গে। লিখেছিলঃ “সব সম্পর্কের
নাম হয় না।” শেষ বিকেলের কলকাতায়।
মধ্যরাতে রাজপথে অথবা ছাদে। নইলে কেন এমন অমোঘ টান। যাকে দেখলে চেনা যায় না। তাঁর
জন্য। যার পরিচয় শুধু লেখার অক্ষরে। শব্দের-ছাঁদে। বর্ণনায় কেবল। শহর থেকে দূরে।
তাঁর আধুনিক মেট্রোপলিস মন বিদ্রোহ করে। ইচ্ছে করে নিয়ম ভাঙ্গতে। “একবার মুখোমুখি বসিবার তীব্রতম টান” লিখেছিল সে।
প্রত্যুত্তরে। বলেছিলঃ “কিন্তু...নামহীন কোন সম্পর্ক হয় না।”
মহানগরে শান্তি নেই। তাই তাঁর কোন নিকেতনও নেই। শহরে
শান্তিনিকেতন থাকতে পারে না। তাই সে শহর থেকে দূরে। লালমাটির খোয়াই টিলার দেশে।
বাড়ি একটা আছে। তবে সে তাঁর ঘর নয়। ছোটবেলা থেকেই প্রথমে স্কুল। তারপর কলেজ আর
বিশ্ববিদ্যালয়। এই হস্টেল থেকে ঐ হস্টেল। তাঁর কাছে হস্টেলই ঘর। মা-বাবা আছেন।
আত্মীয়তা আছে। তবে আত্মা নেই। নিয়ম মেনে বাড়ি
যেতে হয় তাই যাওয়া। কিন্তু ঘর মেলে না। বেঘর মেয়ে ক’দিনের মধ্যেই
হাঁপিয়ে ওঠে। সাত মহলা
তাঁর সয় না। তাই পালিয়েছে বহুবার। নানা অজুহাতে। লিখেছিল মেয়ে। জয়িতা নাকি জয়তী না
জয়িত্রী, নাম যে মেয়ের।সেই চিঠিতেও আরেক-না-দেখা-ছবি।
পাতার বাঁদিকে খোয়াই। বর্তুলাকার। উচু-নীচু। মাঝে লেখা। এঁকে বেঁকে নদীর মত। না-জড়ানো, না-গোটা
ছাঁদের অক্ষর। ঋজু তীক্ষ্ণ সপাট লেখা। চলনে সেই পুরানো গতি নেই। মধ্য যামে নদীর মত
গর্ভিনী অক্ষরের চলন। আর একটা ছবি। পাতার ডান কোণে। যেখানে তারিখ লেখা হয়। সেই
এক্কেবারে ডানপ্রান্ত ঘেঁষে কাটাকুটি। অনেক কিছু লেখার পর যেন কেটে দেওয়া হয়েছে।
কালো আঁকিবুঁকি। যেন ঐখানে শুয়ে আছে অন্ধকারের মাঠ। মাঝে মাঝে সাদা। আলো ঝলকানি।
ফের মেঘ। কালো কালির। ডানপ্রান্তে অন্ধকার গোঙাচ্ছে। একঝলকে মনে হতেই পারে মেঘ
জমেছে ঈশান কোণে। তাই কি লিখেছিল,মনের ঈশান কোণে মেঘ জমেছে। চিঠি লেখার খাতাকেও
রেহাই দিল নাহ।
আশঙ্কা বাড়ছিল। জোয়ার আসছিল উৎসাহে। প্রেরকের। প্রাপকেরও। আকর্ষণ বাড়ছিল। পরষ্পরকে দেখার। তবু সাহস
হচ্ছিল না। একটা ছবি কি আসতে নেই? জানতে চেয়েছিল নৈঋত। জবাব এসেছিল ‘নিয়ম নেই’।
জানাতে চেয়েছিল সেই মেয়েও। জয়িতা নাকি জয়তী না জয়িত্রী। লিখেছিল, পাঠ শেষ।
শান্তিনিকেতন ছেড়ে ফিরতে হবে। এবার। বকুল ফুল গাছের বাড়িতে। ঘর আর বাড়ি ছেড়ে উড়াল।
অন্য কোনখানে। অন্য কোন জনপদে। নতুন করে ফের ঘর খোঁজার কাজে। যদি সুযোগ মেলে। তবে
কলকাতা আসবে সে। তখন সে শপথ ভাঙবে।
নিয়ম ভাঙবে পত্রবন্ধুত্বের। ঘুরে দেখবে জোড়াসাঁকো, রবীন্দ্রভারতী,কলেজ স্ট্রিট। “যেখানে স্মৃতিরা থাকেন।
থাকে সর্বনাশের ইঙ্গিত” প্রেরকের নাকি প্রাপকের। জানায়নি। শুধু জানিয়েছিল মেয়ে। “মহানগরের
দক্ষিণ দুয়ার থেকে পশ্চিমমুখো হাঁটবে তাঁরা।”
কলকাতায় মেঘ কেটে গিয়েছিল। মহানগরে বৃষ্টি নেমেছিল। থেমে যাওয়া
ঘোড়সওয়ারের শরীর চুঁইয়ে স্রোত। নেমেছিল বুঝি? ঈশান কোণকে সাক্ষী রেখে শুরু হয়েছিল
দৌড়। কলমের। অক্ষরের। অক্ষর ছেনে শব্দ খুঁজেছে যুবক। শরীর কুঁদে অক্ষর। গালে হাত
সকাল সন্ধ্যাবেলা। উথাল-পাথাল
শহরে আসবেন তিনি। কলমে কি তুলির সাবলীলতা থাকে। সাদাপাতায় কালো লাইন রঙিন হয় কখনো।
তবুও লেখে তাঁর আবাহনঃ ‘তুমি মেঘ,ইচ্ছে হলেই বৃষ্টি হতে পারো, ভেজাতে পারো কারণে,অকারণে...। আমি ধুলোমাখা পথ। শুধু ভিজতে জানি। নিচোল কাদায়
কর্দমাক্ত হয়ে...চাঁদের আয়না হই কি করে?’
পৌষ পূর্ণিমায় খবর এসেছিল। মাঘী পূর্ণিমায় আসবেন তিনি। তখনবই
উৎসবের কলকাতা। জমজমাট পার্ক স্ট্রিট। ময়দানের ধূলোমাখা বই-সরণীতে পাশাপাশি। শরীরে
জায় ফুলের গন্ধ নিয়ে। আসছেন তিনি। জয়িতা নাকি জয়তী
না জয়িত্রী। মুখোমুখি একদিন। অনেকক্ষণ। চেনানোর দায় দুজনকে দুজনার। চেনার দায়ও।
পলি রঙা মেয়ে পাথুরে শহরে। জানাবে বইমেলার কোন কোণে কোন দরজায় থেমে যাবে সিগন্যাল।
থমকে গেছিল সমস্ত সিগন্যাল। ময়দানে অমলতাসের শরীর চোঁয়ানো আলো ঝলসে উঠছিল। প্রতিফলিত হয়েছিল বহুদূরের এক জানালায়। সাহেব পাড়ার ফসিল হয়ে যাওয়া বহুতলে। বিরক্তিকর এসির ঘর্ঘর। কালো ধোঁয়া মাখা পার্ক স্ট্রিট। তারই একটুকরো জানালায় অমলতাস। পিছনে এক না-যুবক, না-তরুণ মুখ। পড়েছিল সেই চিঠি। শ্যাওলা সবুজ কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছিল আলো। জানলার শার্সি দিয়ে। ধীর পায়ে। প্রাচীন ঝাঁঝরি বেয়ে। ধাপে-ধাপে। আর তখনি থেমে গেছিল সিগন্যাল। জেব্রা ক্রসিং বেয়ে এক আলোময় নারী। পার হয়ে আসছেন। মিশে যাচ্ছেন অমলতাস চোঁয়ানো আলোর মধ্যে। ঘুম জড়ানো ক্লান্ত চোখে দেখেছিল ছেলে। স্বপ্নে। দিবাস্বপ্নে নয়। ভোরের স্বপ্নে। ঢাক বেজেছিল হৃদয়ে।
ষষ্ঠী-ঢাকে কি মাদলের ঊন্মাদনা থাকে নাকি? তবে সেই দিন ছিল। বোধনের বোল ওঠে। অসময়ে। মাতাল আনন্দে একমাথা ধুলো নিয়ে ঘরে ফিরেছিল নৈঋত। চিঠিবাক্সে এলিয়ে পড়ে বিলাসিনী। সেই মাতোয়ারা গন্ধ লালমাটির। সেই ব্রাউন খাম। লেফাফার ওপরে লেখা নাম ছন্দহীন।কঠিন বেয়াড়া ছাঁদের অক্ষর। কালো ছাপে দাগানো। অজস্র আঁকিবুঁকি। পরীক্ষার খাতার মত লাল মোটা অক্ষরে দাগানো পরিচিত খাম। প্রাপকের হদিশ না পেয়ে ফিরে আসা চিঠি। ঠিকানা ঠিক। আবহাওয়া যথাযথ। শুধু ফিরে এসেছে চিঠি। ওপরে ডাক বিভাগের ছাপ। লেখা উপরিউক্ত ঠিকানায় খোঁজ মেলেনি প্রাপকের।
কেঁপে ওঠে মাটি। টলমল করে ওঠে জেব্রা ক্রসিং। সেই নারীর প্রতিটি পদক্ষেপে। ধাপে ধাপে কাঁপন। উঠতে থাকে ভঙ্গিল পর্বতের মত। ভেঙ্গেচুরে উঠে যায় আকাশে। থমকে যাওয়া সিগন্যালে। সবুজ থেকে লাল হওয়ার বিরতি যেন। থমকে থাকা হলদেটে আলো। জ্বলে নেভে। নিষেধ নেই। আবাহণও নেই। একসময় ছাড়িয়ে যায় বহুতল মাথা। পেরিয়ে যায়স্মৃতিস্তম্ভ। হারিয়ে যায় মহানগরের স্কাইলাইন। সাদা-কালোর ঢেউ। পাকিয়ে উঠতে থাকে। শান্ত গতিতে। যেন তাড়া নেই কোন। কোন একদিন যেন পৌছে যাওয়া যাবেমেঘ ছোঁয়া দুরত্বে। কোন এক শিখরে। পর্বত অবয়বে বদলে যেতে থাকে। সবকিছু। আর তার শীর্ষে শান্তির চূড়ান্ত শিখরে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। সাদা পোষাক। উড়ন্ত অঝোর ঝড়ো বাতাসে। শ্বেতশুভ্র নীলচে আভার ঢাকাপ্রতিবেশ। পায়ের কাছে, নীচে,অনেক নীচে। অলস এক উপত্যকার মত মহানগর। সবুজ কংক্রিট দুনিয়াদারি। বহতা নদী রাস্তা জনপদ। দোলাচল। ফুল ঝরে। পাতা ঝরে। ঝড়ো বাতাসে কেশ ওড়ে। ওড়ে বসন। তিনিঅপেক্ষায় থাকেন। আশায় থাকেন। কারো জন্যে। অনন্ত মুহূর্ত যেন। কোথাও যাবেন হয়তো। তাঁর প্রতীক্ষায়। কেউ আসবেন সেই অপেক্ষায়। শুধু উপত্যকাটুকু আর পার হওয়া হয় না।
সুতো ছেঁড়া ঘুড়িটা তখনও উড়ছে। দাবিহীন। ঘরের এক কোণে নৈঋত।
অন্ধকার ঘরে বুনো সবুজ আলো। কোলে ল্যাপটপ। মুখে আছড়ে নেমেছে নীলচে আলো। বহুদূরে
সন্ধ্যা নামলেও ঘরে আলো জ্বালানো হয় নি। এখনো।
আঙুলে ব্যালেরিনা গতি। “...দুশো বছরের পরও চেনা যায় পলি। দুহাজার বছর
পরও ফসিল হওয়া পলিতে আবিষ্কৃত হতে পারে জীবন…যে অপেক্ষায়
থাকে। কোন এক বিস্মৃতির অতলে।”দক্ষিণ-পশ্চিমের জানালায় বসে
ল্যাপটপে লিখে ফেলল লেখক। তাঁর আগামী লেখাটা। যদি দেখা মেলে সেই মেয়ের। যার নামটা
এখন আর মনে পড়ে না। জয়িতা নাকি জয়তী না জয়িত্রী।
ত্রিদিব
ভট্টাচার্য
কলকাতা-৭০০০৫৬
কলকাতা-৭০০০৫৬