Tuesday, January 31, 2017

#বেয়াড়া ১৭

“আগে ব নাকি পরে ব হবে? কাকু বানানটা কি গো?”
মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখি, দুই বিনুনী আর একমাথা চুল পেরিয়ে একটা কচি মুখ ঘরের জানালায়। মাত্র তিনফুটের গড়ন। যেন কোন গোপন ষড়যন্ত্রের কথা জানাতে চাইছে। এতটাই নামানো গলার স্বর। চোখে মুখে উত্তেজনা। ফরসা মুখ গোলাপি প্রায়। একে শনিবাসরীয় ছুটি। চা-খবর কাগজ আর মোবাইল সঙ্গী করে অলস বসে জানালার ধারে। সাড়ে ন’টা দশটার রোদ। তখনও ভেজা। জানালা পেরিয়ে বিছানায়। অজুহাত অলস সময় কাটানো। তাই মুখে কাগজ ঢাকা, পাশে মোবাইল। মুখ ফেরাতেই চোখে পড়ল। তিনি একা নন। সঙ্গী সমবয়সী আরো কয়েকজন। তাঁদের ক্ষুদে হাতে সস্তার ডটপেন। আর ছাপানো বিলবই। কৌতূহলী মুখে তাকিয়ে আমার দিকে। ছোট্ট গলায় ভীষণ তাড়া। “বল না, আগে ব নাকি পরে ব বসবে?” মুহূর্তে ফিরে গেলাম নিজেদের ছোটবেলায়। মজার গলায় জানতে চাইলাম, “কেন রে, কি হল?” “আরে, ওই বাড়ির দাদু। খুব রাগী। খালি বানান জিজ্ঞাসা করে।” সন্তর্পণে জানালে। পাছে কেউ শুনে ফেলে। “চাঁদা চাইতে গেলে তো বানান বলতেই হবে।” “সেইজন্যই তো বাড়িতে মুখস্ত করেছিলাম। কিন্তু এই বিল্টুটা দিল গুলিয়ে”। ততক্ষণে মুখ বাড়িয়েছেন বিল্টু। প্রথম বক্তার ঘাড়ের পাশ দিয়ে। খাড়া খাড়া চুল। তেমন খাড়া কান-জোড়া খরগোশের মত।উজ্জ্বল চকচকে চোখ। ততোধিক ফিসফিসিয়ে মিহি গলায় ঝামরে উঠল। “আমি গোলালাম কোথায়? তুই-ই তো ঘাবড়ে দিলি। আগে নাকি পরে বলে।” তারপরেই মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা, “কাকু, সরস্বতী বানানটা কি গো?” “কেন তুই জানিস না? আবার পুজোর চাঁদা চাইতে বেড়িয়েছিস!” চোখ পাকিয়ে বললাম। “আরে জানতাম তো, কিন্তু এই যে বিনিটা...আগে ব নাকি পরে ব বলে গুলিয়ে দিলে। এখন আর মনে পড়ছে না। ব-টা কোথায় বসবে। বল না, ব-টা কোথায় বসবে? আগে নাকি পরে ?” “জানা বিষয়গুলো গোলাস কেন তাহলে?” ক্যাটক্যাট করে শুনিয়ে দিলেন বিনিরাণী।
সত্যি তো। কঠিন সমস্যা ! জানা বিষয়গুলো গুলিয়ে গেলে বুঝি এমনই হয় ! মনে পড়ছিল নিজেদের ছোটবেলা। হাসিও পাচ্ছিল। সেইসব বিড়ম্বনারগুলো মনে করে। ভাবছিলাম গল্পটা ওদের বলেই ফেলি। কিভাবে জলের দেবী বদলে যাচ্ছিল বিদ্যার দেবীতে। কিন্তু এঁনারা এতটাই ছোট...সম্বিত ফিরল ডাকে। ফের কানে এল, এবার একা নয়। একদম একজোড়া নরম গলায় আবদার, “বল না, আগে ব নাকি পরে ব?”
সত্যি তো ব আগে বসলে গলার আওয়াজ বাড়ে। কিন্তু সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু পরে ব বসলে তিনি বদলে যান। জলের দেবীতে। চিরচঞ্জলা-গতিশীলা নদী। নাকি নারী? শাস্ত্রের এই এক বিপদ! কখন নদী, নারী হয়ে যায় ! কখন আবার নারী, নদী হন। শাস্ত্রীয় জটিলতায় খামোকা না ঢুকে সেই কচি মুখগুলোর দিকে তাকাই ফের। আর মাথার ভিতর ভিড় করে আসে অনেকগুলো গুলিয়ে দেওয়া ছবি। ইদানিং রাস্তার ধারে হরেক আকারের ব। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছোট-বড় বিজ্ঞাপন। যেখানে ইয়াব্বড় করে আঁকা ব। সেই ব-গুলো আগে বসেছে নাকি পরে? কিন্তু এরা তো একলা! টেলিভিশনের পর্দায় প্রতি সাড়ে তেরো মিনিট অন্তর ভেসে আসে ব। তার সর্বগ্রাসী খিদে নিয়ে। গ্রাফিক্সটাও যেন সেই রকম করেই বানানো। এক বিশাল ব-এর পেটের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে গোটা দুনিয়া। গাড়ী-বাড়ি-চাষের জমি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, কল কারখানা-অফিস-থানা-আদালত থেকে শ্যালো-পাওয়ার গ্রিড পর্যন্ত। কেমন এক সর্বগ্রাসী ক্ষুধা যেন। সব কিছু গিলছে একটামাত্র ব। দু-পাশ থেকে তিন কোণাচে শ্বাপদের মত, নাকি যন্ত্রের মত গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে তারা। চন্দন সেন নাটকের লোক। তিনি সামনে থাকলে না হয় ঠিকঠাক বুঝিয়ে বলতে পারতেন। হয়তো বলতেন, একটা আসছে, লেফট-ডাউন স্টেজ থেকে। কোণাচে জ্যামিতিক চিহ্ন। আর একটা আসছে রাইট-আপ স্টেজ থেকে। দুই অস্ত্রের মত। দু’কোণ থেকে দুই তীক্ষ্ণ অংশ। শনশনিয়ে এগিয়ে আসে। ঠিক স্টেজের মাঝখানে এসে তারা জুড়ে যায়। একে অপরের সঙ্গে। তৈরি হয় ব। মিলনের কোন আওয়াজ হয় কি? না বোধ হয়। আর তক্ষুনি ব্যাস! কী দানবীয় শক্তি তার। কী তার সর্বগ্রাসী ক্ষিধে ! ব-এর তীব্র টানে যেন হু-হু করছে চারপাশ। পড়িমরি করে এগিয়ে আসছে যতেক দুনিয়াদারি। ছুটে আসছে যা কিছু প্রাকৃতিক। যা কিছু সর্বজনীন। সব যেন পারিবারিক হয়ে যাচ্ছে। ব-এর কল্যাণে। যা আছে চারিপাশে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তার সব নিজের গর্ভে নিয়ে তবে শান্তি!
তবে রঙ বিন্যাসে তেমন ভয়ঙ্কর নয়। কেমন যেন মরা টিকটিকির পেটের মত হলদেটে রঙ। উষর আর ফ্যাকাশে। পিছনে আকাশ নীল আর মরা সবজেটে রঙের মাঝে বিশালাকৃতি হলুদ ব। মোটাসোটা কৃমির মত। ফ্যাকাশে মমি যেন। লটকে আছে মহানগরের প্রতিটি রাস্তায়। প্রতি ছ’খানা ল্যাম্প-পোস্ট অন্তর। দেখা মিলছে বেশিরভাগ টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপনের বিরতিতে। প্রতি সাড়ে তেরো মিনিট অন্তর। স্ক্রিন জোড়া ব। বেশিরভাগ খবর কাগজেও। হিন্দি বাংলা ইংরাজিতে। ভাষা কোন বাধা নয়। কাগজের মান অনুযায়ী ব। ডবল ফুলপেজ থেকে হাফপেজ জুড়ে। একখানা ব। রাজ্য জুড়ে, এ হেন ব-এর ব্যাপকতা দেখে বেবাক ভয়ে ভয়ে থাকি। তবে আশার কথা এখানে ব মানে বিশ্ব, এখানে ব মানে বাংলা। আর ব মানে বিশ্ববাংলা ! “কী হল ? তুমিও কি ভুলে গেছ, সরস্বতী বানান? আগে ব নাকি পরে ব?” জিজ্ঞাসায় সম্বিত ফেরে। “তোরাই বল না বানানটা। ভুল হলে ধরিয়ে দেব। তবে কাউকে জানাব না। নিজেরা বললে দেখবি মনে থাকবে।” আরো এক ব-এর মনে এল। গল্পে শুনেছিলাম। নাকি পড়েছিলাম। একালের নয় সেকালের কাহিনী। প্রায় ১৭২ বছর আগের কোন একদিন। সেদিন জোড়াসাঁকোর সিঙ্গি পরিবারে ভারি ধুমধাম। কে না চেনে সেই বাড়ি? হিন্দু কালেজের একজন পরিচালক জয়কৃষ্ণ সিঙ্গির বাড়ি বলে কথা! সকাল থেকেই ভিয়েন নহবতে হৈচৈ। সকাল থেকেই তোড়জোড়। ওড়ানো হচ্ছে পায়রা। আকাশে উড়ছে রংবেরঙের ঘুড়ি। দেশের নামীদামী মানুষের নিমন্ত্রণ। সিংহদুয়ারে একে একে এসে থামছে জুড়ি গাড়ি, পালকি। নামছেন সমাজের এক-একজন বিশিষ্ট মানুষ। বিদ্বান-পন্ডিত-ব্যবসায়ী-সমাজ সংস্কারক বাদ নেই কেউ। সবাই নিমন্ত্রিত। সকাল থেকেই গোলাপ জল, আতর আর খুসর’র গন্ধে ম’ম’ করছে আশপাশ। আয়োজন এমনই এক বসন্ত পঞ্চমী ঋতুতে। কারণ জয়কৃষ্ণের নাতির হাতেখড়ি। আর হাতেখড়িও দেবেন সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ পন্ডিত স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মশাই। যাকে গোটা দেশ চেনেন বিদ্যের সাগর হিসেবে। তাই ভেঙে পড়েছেন উনবিংশ শতকের পন্ডিত সমাজ। শুভক্ষণ সমাগত। বিদ্যাদেবীর আরাধনা শেষে। পুরোহিত ঈশ্বরচন্দ্রের কোলে তুলে দিলেন জয়কৃষ্ণের নাতিকে। সবাই স্তব্ধ হয়ে দেখছেন। হাতেখড়িতে প্রথম কী লেখা ফুটে ওঠে পাথরের স্লেটে। ঈশ্বরচন্দ্রের পরনে ধুতি আর মটকার চাদর। সেখানে হেলান দিয়ে বসে, রাজবেশে শিশু কালীপ্রসন্ন। মাথায় মুকুট। মৃদু হাসি পন্ডিতের মুখে। চোখে শিশুর দৃষ্টি। কষ্টিপাথরের স্লেটে খড়িমাটি দিয়ে আঁক কষে শিশুকে প্রথম অক্ষর চেনাবেন সে যুগের শ্রেষ্ঠ পন্ডিত। সবাই স্তব্ধতার সঙ্গে অপেক্ষা করছেন। প্রথম আঁকে কি লেখান তিনি? কিন্তু কোথায় কি? শিশুটির কচি হাতে খড়িমাটি দিয়ে মাথা নীচু করে গল্প করে চলেছেন ঈশ্বরচন্দ্র। বলে চলেছেন আকাশে ঘুড়ি ওড়ার গল্প। কেমন দেখতে সেই ঘুড়ি? শিশু কালীপ্রসন্ন মনের আনন্দে এঁকে ফেলেন ঘুড়ি। এইবার সেই ঘুড়ির ডানদিকের আধখানা নিজের মটকার চাদরে মুছে দিলেন। এবার বাকি অংশে খড়ি বুলিয়ে দুজনে মিলে লিখলেন ব। সেই দিনের শিক্ষক। হাতে খড়ি দিতে এসে শিশুকে প্রথম যে অক্ষর চিনিয়েছিলেন। লিখিয়েছিলেন সেটি একটি ব। এর বছর পাঁচেক বাদে বর্ণ-পরিচয় লিখবেন সেই শিক্ষক। যা ভবিষ্যতের সমস্ত বাঙালি সন্তানকে বাংলা বর্ণের সঙ্গে পরিচয় করাবে। ভবিষ্যতে নিজের লেখা বর্ণ পরিচয়ে স্বরবর্ণের প্রথম বর্ণ অ কিম্বা আ দিয়ে নয়। নয় ব্যঞ্জনের প্রথম বর্ণ ক বা খ। শিশু কালীপ্রসন্ন সিংহকে বিদ্যাসাগর মশাই প্রথম অক্ষর শিখিয়েছিলেন ব। যা লেখা সহজ। কারণ তা জ্যামিতিক। আর চেনা সহজতর। পরিচিত খেলার সঙ্গে মিশ খাওয়া এক অবয়ব। “দন্ত্য স, ব-এ শূন্য র...” সরস্বতীর সন্তানরা বলে চলেছেন... আর মাথায় চরকি মারছে ব তুমি কার? আধখানা ঘুড়ি মানে ব। এক জ্যামিতিক অবয়ব। তিনকোণা অক্ষর। ত্রিকোণ। লিখনে সুবিধা। ওপরে মাত্রা। অথচ চোখের সামনে ভাসছে আরেক জ্যামিতিক ফর্ম। একখানা গ্লোব। চৌরাস্তার মোড়ে। যেখানে আগে একটা মূর্তি ছিল। পরমা মূর্তি। তাকে ভেঙ্গেচুরে সরিয়ে সেইখানে বসেছে সেই গ্লোব। যার গায়ে আঁকা বাংলা বর্ণমালার ২৩ তম অক্ষর ব। ওপর নীচে বাংলায় আর ইংরাজিতে লেখা বিশ্ব বাংলা। বিশ্ব বাংলা বললেই কেন জানি একটা দোকান ঘর চোখে ভাসে। দক্ষিণাপনে। উত্তরাপনে। কিম্বা কলকাতা এয়ারপোর্টে। ঝাঁ চকচকে মাল্টি-কর্ণারড এরিয়া। দশগুণ দামে বিক্রি হওয়া সামগ্রী। অসাধারণ মানুষ জনের ততোধিক অসাধারণ বিকিকিনির জায়গা। এমন এক দামি দোকান। যেখানে পা দিতে ডরায় সাধারণ মানুষ। পকেটে রেস্ত কম যদি একটা কারণ হয় তো অন্য কারণ অবশ্যই তাঁর নিজের দুনিয়ার সঙ্গে বড্ড অশ্লীল রকমের বেমানান বিশ্ব বাংলা। আরেক বিশ্ব বাংলা আছে। আছে নয় ছিল। সত্তর সালের মার্চ মাসে তৈরি হওয়া একটা ‘ব্র্যান্ড-নেম’ হয়ে। নয়ের দশক পর্যন্ত। এন-আর-আইদের বিশ্ব বাংলা ‘ব্র্যান্ড-নেম’-এ জিনিসপত্র বিক্রি করে এসেছে। যার ট্যাগ লাইনে বলা ছিল, ‘এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের বিস্তর সুযোগ সুবিধাও আছে’। মোদ্দা কথা বাংলার আর্টিজানদের কাছ থেকে কম দামে জিনিস কিনে ‘বিশ্ব বাংলা’ নামটির স্টিকার লাগিয়ে বিশ্বের যেকোন প্রান্তে তারা পাঠাতেন। কয়েকশো গুণ বেশি দামে। লাভের গুড় তাঁরাই খেতেন। মূল শিল্পীরা থেকে যেতেন ব্রাত্য। তাঁদের কেউ চিনতেন না। সম্প্রতি বিশ্ব বাংলা নামটিও বেদখল হয়েছে। চুরি বললে চুরি। বেহাত বললে বেহাত। তবে এটা ঠিক। হাত বদল হয়নি। ঘটনাটি বেশ মজার। অনেকটা সেই যাত্রা দলের পালার নামচুরির মত। এখন আর সেই পালাকার ভৈরব বাবুও নেই যে তিনি কিছু বলবেন। সত্তরের নামের ভুবনমোহিনী ব্যবহার হল ৩৪ নয় ৪৪ বছর পর। আঁকা হল ব। বানানো হল লোগো। তৈরি হল কোম্পানি। এমন মেজাজ। যেন তিনিই আদি এবং অকৃত্রিম। ব্র্যান্ড নিউ প্রোডক্ট লঞ্চ হল। নাম বিশ্ব বাংলা। রাজ্য সরকার তৈরি করেছে বিশ্ব বাংলা। একটা প্রতিষ্ঠান। ব্র্যান্ড বিশ্ব বাংলা। বাঙালির অহংকারের তীব্রতাকে উস্কে দিলেন রাজ্যের সরকার। আমার বাংলা বিশ্বমুখীন। আমার সরকার বিশ্বজনীন। বিশ্ব জননীও বললেন কেউ কেউ। বাঙালির ব্র্যান্ড। বাংলার ব্র্যান্ড। এই সেই গতিমুখ যার মধ্যে দিয়ে দুনিয়া চিনবে বাঙালিকে। আর বাঙালি পৌঁছাবে বিশ্বের দরবারে। ২০১৪ সালে, সরকারি ভাবে আত্মপ্রকাশ বিশ্ব বাংলার। ডিসেম্বর মাসের শেষ দিনে। একত্রিশে। অর্থাৎ নতুন বছর, ২০১৫, থেকেই বাঙালি বিশ্ব নাগরিক। সরকারি সংস্থা। সরকারি ব্র্যান্ড। ম্যানেজমেন্টে সরকারের লোকজন। সরকারি ঠিকানাঃ নিউ টাউন, রাজারহাট। মুখ্যমন্ত্রীর ড্রিম প্রজেক্ট। তাঁরই ব্রেন চাইল্ড। ধন্য ধন্য চারিদিকে। বাঙালি আত্মবিশ্বাস আর আত্মমর্যাদাকে এক লাফে শিখরে পৌছে দিলেন তিনি। তারই প্রতীক বা লোগো সেই ব। ব এঁকেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। সেই ব কিন্তু সবসময় এগিয়ে থাকা ব। মানে বাংলায় আগে ব। বিশ্বে আগে ব, পরে ব-ফলা। আর বিশ্ব-বাংলায় তো কথাই নেই !
কিন্তু এক রহস্যময় ঘটনা ঘটল। একেবারে হাল আমলের আবিষ্কার। সরকারের কোম্পানি জন্মানোর আগেই লোগো রেজেস্ট্রি হয়ে গেল। বলা ভাল জন্মের ঠিক এগারো মাস আগে। সন্তান জন্মাতে দশ মাস সময় লাগে। আর কোম্পানি জন্মাতে সময় লাগল এগারো মাস। যেন রামের জন্মের আগেই লেখা হয়ে গেল রামায়ণ।
রেজেস্ট্রির তারিখ ২০১৩-র নভেম্বরের ছাব্বিশে। এখানেও ব। একেবারে গায়ে গায়ে লেগে। কিন্তু তীব্র গোল বেধেছে অন্যখানে। কোম্পানির মালিকানা সরকারের। ঠিকানা নিউটাউন রাজারহাটে কারিগরি ভবনে। কিন্তু লোগো রেজিস্ট্রিশনে সরকার নেই। রেজেস্ট্রি হল একজন ব্যক্তির নামে। নাহ তার নামে অবশ্য কোন ব নেই। ব্যবহার করা হল সেই ব্যক্তির বাড়ির ঠিকানা। সেই ব্যক্তির হয়ে আবেদননামা পাঠালেন কলকাতার সি জে অ্যাসোশিয়েটস। আর সেই ঠিকানায়, তিরিশের বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটেই নাকি বসবাস করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। যিনি রাজ্য সরকারেরও মাথা। হতবাক রাজ্যবাসী ! এমনটা হয় নাকি? জানা বিষয় গোলালে যা হয় আর কি ! ঠিক আমাদের বিনি আর বিল্টুর মত। “...দন্ত্য স-এ ব-ফলা, ত-এ দীর্ঘ ই-কার। ... কী ঠিক বললাম ?” ফের সেই কচি গলার জিজ্ঞাসা। এবার বিনির। অন্যমনস্ক ছিলাম বলে শোনা হয়নি পুরোটা। বলি কি করে? তাই ওস্তাদি বড় সুলভ। বিল্টুর দিকে তাকিয়ে বললাম, “এবার তোরটা শুনি...” নিশ্চিত আমি। দুজনে দুরকম বানান বলবে। বলবেই। কম বিচ্ছু এই দুটো। “বিনিরটা হয়নি ? তাই না?” “কে বললে হয়নি? ওরটা ঠিক কিনা পরে বলছি। আগে তোরটা বল? আগে ব নাকি পরে?” বলে ভুরু নাচাই জিজ্ঞাসার স্টাইলে। “পরেই ব হবে মনে হচ্ছে।” মাথা চুলকে জানাল বিল্টু। না থেমেই বলে চলল, “জানো না দাদু শিখিয়েছে তো ‘সোয়াতি’ উচ্চারণ হলে, মানে ‘ওয়া’ হলে ‘এস-ডবলু’ আর ‘স-এ ব’। সরস্বতী ইংরাজি বানান হল ‘এস-এ-আর-এ-এস-ডবলু-এ-টি-আই...” “বাহ জানিস তো বানানটা।তাহলে যে বলছিলি...” কথা শেষ হওয়ার আগেই বিনি দেখাল বিল্টুকে। আর বিল্টু বিনিকে। তারপর একসঙ্গেই বলে উঠল, “ঐ বাংলা বানান তো তাই কনফিউশন ...। বললাম না, ওই দিল গুলিয়ে ... আগে ব নাকি পরে ব বলে।”
চোখ কপালে ! বাংলায় সরস্বতী বানান মনে রাখার ইংরাজি দস্তুর। বুঝুন কান্ড। ইংলিশ মিডিয়াম নিশ্চিত। বেচারা বিল্টু! ...বিল্টুকে আর বেচারা আর বলি কি করে। এটাই ওদের স্টাইল। ওদের নিজস্বতা। মনে রাখার। চিনে রাখারও বটে। এটাই ভরসা। ওরা চিনে রাখতে পারবে। পারবে মনে রাখতে আর প্রতিরোধ গড়তে। ওরা আমাদের মত না। যেভাবে আমরা গত দশ বছর ধরে, ঠেক খেতে খেতে চিনছি, বাংলা বর্ণমালার ২৩ তম অক্ষরটাকে। কিন্তু এখনো বুঝে উঠতে পারছি না সেই ‘ব’ আগে বসেছে নাকি পরে। নাকি এক্কেবারে সমাজের মধ্যিখানে শিকড় গেড়েছে !

(C) ত্রিভ ২৮ জানুয়ারি,২০১৭

Thursday, January 19, 2017

সর্বরোগহর

সর্বরোগহর

বচসা বিলাপের দিন শেষ। এখন রাঙানোর দিন। দেওয়াল রাঙানো থেকে চোখ রাঙানো। ফুটপাথ থেকে ওভারহেড ব্রীজ রঙিন হয়েছে। নৌকা থেকে নবান্ন। নীল আর সাদা। মোদ্দা কথা রঙিন। সঙ্গে গান।কখনো রবীন্দ্র, কখনো অতুলপ্রসাদ। যে ঋতুতে যা যায়। মানে খায় । পাবলিক। একাজ মোটামুটি শেষ। বাকিটা চলছে। চলবে নিয়ম মোতাবেক। *** এখন চোখ রাঙানোর সময়। নব্য থেকে পুরাতন। সব্বাই চোখ রাঙিয়েই আছেন। পান থেকে চুন খসার প্রয়োজন নেই। সরকারে থাকতে গেলে একটু-আধটু রাঙাতেই হয়। নইলে নাকি নাম বাড়ে না। অতএব, নামের জন্য প্রাণপাত। একটু চমকে। একটু ধমকে কাজ হলে ভালো। নইলে, চপেটা থেকে লাঠ্যৌষোধী তো আছেই। আর আছেন কিছু স্তাবকবৃন্দ। তাঁরা জানেন। কিভাবে রাঙাতে হয়। গণ্ড থেকে গঞ্জ। *** গঞ্জের বাসিন্দা আমি। ভয়ে ভয়ে থাকি। পিতৃদত্ত দুটি বৈ তিনটি গণ্ড তো নাই। সর্বরোগহর ভেবে ডেকে আসন দিয়েছি। পাত পেড়ে ভাত বেড়েছি। ভাতের পাতে চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় আয়োজন। ভালোবেসেই। রোগহর নিদান তো মিলবে। এখন দেখি আমারই আঁচল ধরে টানাটানি। সম্ভ্রম বাঁচানোই দায়। ঘর ভাঙা চিৎকারে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করেও বিচার মেলে নাহ। সবই নাকি ছোট্ট ঘটনা। চক্রান্ত। *** চক্রান্ত বলে চক্রান্ত। এমন এর আগে দেখিনি বাপু ! সব্বাই কিনা হাত ধুয়ে পিছনে পরে গেল। এমন কি সাংবাদিকগুলোও। একদিন যারা সর্বরোগহর বলে প্রচার করেছিল। রেল থেকে বেইল আউট সব রোগের নিদান দেখেছিল হাতে। বলেছিল দশভূজা। যে গুলোকে নাইয়ে-খাইয়ে মোটা সোটা করলাম। সেগুলোই কিনা গেল বিগড়ে। বলছিলাম নতুন প্রেস কর্নার গড়ে দেব রাইটার্সে। ঘোড়ার ডিম । এবার ওগুলোকেই আটকে দেব নবান্নের সাজানো গোছানো ঘরে। নির্দেশ দোতলার ওই ঘর দুটো থেকে বেরোন মানা। বেরোলেই পিছনে ফেউ। না মানলেই গ্রেফতার। জানানো হয়েছে এই নয়া ফরমানের সঙ্গে অভ্যস্ত হোন সংবাদ কর্মীরা। নইলে ... হু হু বাবা... *** শুরুতেই বলেছিলাম। এখন বচসা বিলাপের দিন শেষ। এখন চোখ রাঙানোর সময়।
ত্রিভ ৯/১২/২০১৪